‘ঈদ’ শব্দটির আরবি শব্দমূল ‘আউদ’। এর অর্থ যা বারবার ফিরে ফিরে আসে। ‘ফিতর’ শব্দের অর্থ ভেঙে দেয়া, ইফতার করা। ঈদুল ফিতর মানে সে আনন্দঘন উৎসব, যা দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর আসে। আসে আনন্দবার্তা নিয়ে। আসে জীবনের মূল্যবোধ জাগ্রত করতে। আবার ‘ঈদগাহ’ বলতে নামাযের জায়গাকে বোঝানো হয়েছে। যে স্থানে ঈদের নামায আদায় করা হয়ে থাকে সেই স্থানকে ঈদগাহ বলা হয়। অর্থাৎ ঈদগাহ শব্দের অর্থ ফিরে আসার স্থান। মুসলমানগণ ঈদের নামাজের জন্য বছরে দুইবার যে স্থানে ফিরে আসে তাকেই ঈদগাহ বলা হয়ে থাকে।
পবিত্র রমজানের এক মাস সিয়াম সাধনার পর আসে সেই আকাঙ্খিত মহিমান্বিত দিন। সমগ্র মুসলিম জাতির জন্য এ দিনটি বিশেষ মর্যাদায় আসীন। এক মাস সিয়াম পালনের মধ্য দিয়ে শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা যায় আকাশজুড়ে। সেই চাঁদের উজ্জ্বলতা সারা পৃথিবীকে আলোক উদ্ভাসিত করে। চিকন রেখার চাঁদ যেন মুচকি হেসে বলে ওঠে- এই যে আমি। অপেক্ষা শেষ করতে এসে গেছি। আসে মুচকি হাসির সাথে। আনন্দের মহিমায় যুক্ত হয় সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ। মাঠে মাঠে ঈদের নামাজ আদায়ের দৃশ্য হৃদয় জুড়িয়ে দেয়। ঝড়-বৃষ্টি কোনো কিছুই বাঁধা হয়ে উঠে না। কেবল হাসিমুখের ছবি ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ঈদুল ফিতরের সর্বজনীনতা ও ব্যাপকতা এতটাই বিস্তৃত যে মুসলিম জাতি তথা অন্যান্য জাতির কাছেও এর গুরুত্ব অধিক।
বর্তমান যে সময়ে আমরা দাঁড়িয়ে তাতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের ঈদ আয়োজনে চলে চাপা অস্থিরতা। জীবন চালানোর জন্য পর্যাপ্ত অর্থ আয়ই মানুষকে অসহায় করে তোলে। একদিকে অনেকের ঘরেই যেমন থাকে বাহারি খাবারের আয়োজন। অন্যদিকে কারো ঘরে দেখা মেলে পান্তা ভাত বা শুকনো রুটি। যারা এ আনন্দ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করে তারাও সামাজিকভাবে নিজেদের লুকিয়েই পথ চলে।
ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক-অর্থনৈতিক মূল্যবোধ ও সাম্যতা গঠনে ঈদুল ফিতর এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে অনাদিকালের সাক্ষী হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ঈদের আনন্দ মানুষের মনে এনে দেয় প্রশান্তি। নিয়ম মেনে চলতে শেখায়। শৃঙ্খলার মধ্যেও যে আনন্দ আছে তা জানান দেয়। একসাথে দলবেঁধে তারাবিহ নামাজ আদায়ের মাধ্যমে মনে হয় রমজান যেন প্রশিক্ষণের মাস। এ সময় পরিচ্ছন্ন হয়ে ওঠে মানুষের মন। হিংসা-বিদ্বেষের স্থলে মানুষের মনে স্থান করে নেয় ভালোবাসা-সম্প্রীতি-মায়া। আত্মীয়-স্বজন, ব›ধু-বান্ধব সবার সাথেই নতুন করে সম্পর্ক তৈরি হয়। কোনো কষ্ট, রাগ, অভিমান সব ভুলে ঈদের আনন্দ হয়ে ওঠে সবার। এ আনন্দে সাহায্য সহযোগিতার একটি বিষয় বড় হয়ে ওঠে। সারা বছর সেভাবে খোঁজ-খবর না রাখলেও রোজার এ সময়টাতে তা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে। প্রতিবেশী কেউ কষ্ট করছে কি না। নিকট আত্মীয়দের মধ্যে কারো সমস্যা আছে কি না। তাদেরকে ভালোবাসার মাধ্যমে আপন করে নেয়াই মূলত ঈদের আনন্দ। ঈদের শিক্ষাও বটে। সামাজিক গুরুত্বের এটি একটি বড় অংশ।
ইসলাম সবার জন্য ঈদ আনন্দের পথ তৈরি করে দিয়েছে। জাকাত আদায়ের শিক্ষা দিয়েছে। সমাজের গরিব, মিসকিন ও নিম্ন আয়ের মানুষের পাশে থেকে তাদের অংশ হবার তাগিদ দিয়েছে। এটি আদায়ে সমাজের নিরন্ন অসহায় মানুষের মুখে অনাবিল হাসির রেখা দেখা যায়। অর্থনৈতিক দৈন্যতা ঘুচিয়ে ঈদের আনন্দ হয় সবার। যার যা প্রাপ্য তা দেয়ার মধ্যে যে সুখ নিহিত তা আর কিছুতেই পাওয়া সম্ভব নয়। ঈদের দিনটি আসার আগেই ফিতরা আদায় প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জরুরি। এ থেকে বাদ যায় না সদ্য জন্মলাভকারী শিশুটিও। এর মাধ্যমেও অসহায় মানুষ তাদের ঈদ আয়োজন করে থাকে। তাই এটি আদায়ে সচেতন হলে ঈদের আনন্দ হয়ে উঠবে সবার। আমাদের জীবনে ঈদ আসে সুশৃঙ্খল আচার-আচরণের তীর ঘেঁষে। নৈতিক, আত্মিক ও সামাজিক পরিশুদ্ধির সীমানা পেরিয়ে সামষ্টিক কল্যাণ নিয়ে ঈদ আসে। ঈদ আসে কৃচ্ছ্র ও শুদ্ধতার প্রতীক হয়ে। তাকওয়ার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নতুন জীবনে ফেরার অঙ্গীকার নিয়ে। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতমন্ডিত অফুরন্ত কল্যাণের সঙ্গে আলিঙ্গন করে ঈদ আসে। ঈদ আসে শত্রুতা ও বৈরিতার প্রাচীর ডিঙিয়ে বন্ধুতা ও মিত্রতার হাত বাড়িয়ে। ঈদ আসে মহামিলনের মহোৎসবে মনকে মাতিয়ে তুলতে, পরিশোধিত হৃদয়ে পরিতৃপ্তির ছোঁয়া লাগাতে। এ আনন্দ আল্লাহর রহমত ও ক্ষমাপ্রাপ্তির, জাহান্নাম থেকে মুক্তির। এ আনন্দ সিয়াম-কিয়ামের শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতার। এ আনন্দে নেই কোনো অশ্লীলতা,পাপ-পঙ্কিলতা। এ আনন্দে শুধুই সওয়াব ও পুণ্যময়তা। ধীরে ধীরে এ আনন্দ সংক্রমিত হতে থাকে হৃদয় থেকে হৃদয়ে।
সদ্যঃপ্রসূত শিশু থেকে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবার দেহ-মনে ঈদের ছোঁয়া লাগে। হতদরিদ্র, এতিম, দুস্থ, নিঃস্ব ও শত শত ছিন্নমূল মানুষের মুখেও হাসি ফোটে কিছু টাকা, কিছু নতুন কাপড় পেয়ে। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ব্যবসায়ী ও কর্মজীবীরাও এ সময় ব্যস্ত হয়ে পড়েন সমানতালে। ঈদ উপলক্ষে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুবিধা তাঁরাও ভোগ করেন। এভাবেই সর্বজনীন হয়ে ওঠে ঈদ।
ঈদুল ফিতর অর্থ রোজা খোলার আনন্দ। কিন্তু কেন সেই আনন্দ? আনন্দের জন্য তো কোনো কারণ থাকতে হবে! সুখবর পেলেই তো মানুষ আনন্দিত হয়! এক মাস সিয়াম সাধনার পর এই দিনে সেই সাধনার পুরস্কার হিসেবে ক্ষমা পাওয়াই সেই আনন্দের কারণ। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা ঈদের দিন ফেরেশতাদের মধ্যে রোজাদারদের নিয়ে গর্ব করে বলেন, ‘হে ফেরেশতারা, আমার কর্তব্যপরায়ণ প্রেমিক বান্দার বিনিময় কী হতে পারে?’ ফেরেশতারা বলেন, ‘হে প্রভু, পুণ্যরূপে পুরস্কার দান করাই তো তার প্রতিদান।’ আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব (রোজা) পালন করেছে। অতঃপর দোয়া করতে করতে ঈদগাহে গমন করেছে। সুতরাং আমার মর্যাদা, সম্মান, দয়া ও বড়ত্বের কসম! আমি তাদের দোয়া কবুল করব এবং তাদের মাফ করে দেব।’ (বায়হাকি : ৩/৩৪৩)।
ইসলাম-পূর্ব পৃথিবীর মানুষের জন্য বিভিন্ন আনন্দ উৎসব ছিল। তাদের নিজস্ব মনগড়া বানানো সংস্কৃতির চর্চা হতো। বিভিন্ন দিন-তারিখকে কেন্দ্র করে আনন্দের ঢাকঢোল বাজাত। তাদের সংস্কৃতি কিংবা আনন্দ উৎসবে ছিল না সভ্যতার শিক্ষা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহমর্মিতার দৃষ্টান্ত। তাদের উৎসব ছিল না সবার জন্য সমান উন্মুক্ত ও ভেদাভেদমুক্ত। মুসলমানদের ঈদ সংস্কৃতির আগে মদিনায় ‘নাইরোজ’ ও ‘মেহেরজান’ নামে দুটি উৎসব পালিত হতো। দুটি উৎসবই পারস্য সংস্কৃতি ও সভ্যতার দর্পণ। বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে নাইরোজ এবং বসন্ত উৎসবকে উপলক্ষ করে মেহেরজান নামে দুটি বিনোদনমূলক উৎসব পালন করা হতো। অপরিশুদ্ধ মানব মননে আবিষ্কৃত দুটি উৎসবই বেহায়াপনা-বেলেল্লাপনা ও অশ্লীলতার কালো নিকৃষ্ট আঁধারে ছিল নিমজ্জিত। তাদের ভিত্তিহীন সংস্কৃতির মূলোৎপাটন করে শুদ্ধ সংস্কৃতি উদযাপনের পাঠ দিলেন মানবতার নবী মুহাম্মদ (সা.)। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন, ‘প্রতিটি জাতির আনন্দ-উৎসব আছে। আর আমাদের আনন্দ-উৎসব হলো দুই ঈদ।’ (বুখারি, হাদিস : ৯৫২)।
ইসলামের দেয়া দুটি আনন্দ-উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। ঈদ আমাদের শিক্ষা দেয় ত্যাগের। ভেদাভেদ ভুলে যাওয়ার। শ্রেণিবৈষম্যের মূলোৎপাটন করার। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গরিব-ধনী এককাতারে চলার; কিন্তু আমরা কোন ধরনের সংস্কৃতির চর্চা করছি ঈদের আদলে? মানুষ আজ ঈদকে বানিয়ে ফেলেছে পার্থক্যের সুবিস্তৃত মাঠ। ঈদের দিনে মানুষ হয়ে যাচ্ছে মানুষ থেকে ভিন্ন। এলিট-নিম্নস্তরের মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে যোজন যোজন ফারাক। পৃথিবীর এ বিচিত্র পাঠশালার মধ্যে আমরা ভুলে যাচ্ছি আমাদের সভ্যতার সংস্কৃতি ও শেকড়ের শিক্ষা। আমরা গলা টিপে হত্যা করছি আমাদের সভ্যতা ও শেকড়ের সংস্কৃতিকে। ঈদ এলেই ঈদের নামে চলে বেহায়াপনার প্রদর্শনী। ঈদ নাটক, ঈদ গান, ঈদের ছবি, ঈদ রেসিপি ও ঈদ ফ্যাশন এর নামে চলে নোংরা সংস্কৃতির চর্চা। সাত দিনব্যাপী চলে ঈদের নামে প্রহসন। চ্যানেলে চ্যানেলে ভাঁড়ামি, নষ্টামি প্রেম-পিরিতি নিয়ে চলে মাতামাতি। ইসলামের আবিষ্কৃত ঈদের উৎসবে থাকে না ইসলামের কোনো তাহজিব-তমদ্দুনের শিক্ষা। ইসলামের উদারতা, মানবপ্রীতি নিয়ে আলোচনা হয় না কোনো খবরের কাগজ কিংবা টিভি চ্যানেলে। ঈদ উপলক্ষে করা ঈদ সংখ্যায় স্থান পায় না কোনো ইসলামী ঈদ রচনা-প্রবন্ধ-নিবন্ধ। ফিচার বা প্রতিবেদন হয় না কোনো ইসলামী ঐতিহ্য নিয়ে। ইসলামের দেয়া ঈদ উৎসবে চলে ভিনজাতীয় নোংরা সব কালচারের প্রদর্শন। চলে বেহায়াপনার তোড়জোড় আর আস্ফালন।
ইসলাম বিনোদন সমর্থন করে; কিন্তু অশ্লীলতাকে মোটেও প্রশ্রয় দেয় না। ইসলামের উৎসবে ঢোল-তবলা নেই। বিনোদনের নামে অসামাজিকতা ও নগ্নতা নেই। নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ ইসলামে নিষিদ্ধ। ঈমানদারের ঈদের আনন্দ উত্তম পোশাক পরিধান, ঈদের দিন মিষ্টিমুখ করা, সদকাতুল ফিতর আদায় ও ঈদের নামাজ আদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। উৎসবের সঙ্গে মানুষের রুচি ও চাহিদার বিষয়টি জড়িত। অন্যদের উৎসব ও আমাদের উৎসবের মধ্যে পার্থক্য আকাশ-পাতাল। মুসলমানদের উৎসব অপসংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। উৎসবের নামে অনাচার, কদাচার, পাপাচার আর নৈতিকতাবিবর্জিত বল্গাহীন অনুষ্ঠান আড়ম্বরের অবকাশ নেই ইসলামে। আবার বৈধ ও নির্দোষ আনন্দ-ফূর্তি, শরীরচর্চামূলক খেলাধুলা, নৈতিক মূল্যবোধ ও ঈমানি ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ শিল্প-সংগীত এগুলোও ঈদের দিনের বৈধ আনুষ্ঠানিকতার বাইরে নয়। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ঈদের দিন হাবশিরা খেলা করছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) ক্রীড়ারত হাবশিদের উৎসাহ দিয়ে বলেন, ‘ছেলেরা, খেলে যাও! ইহুদিরা জানুক যে আমাদের দ্বীনের প্রশস্ততা আছে। আমাকে প্রশস্ত দ্বীনে হানিফসহ প্রেরণ করা হয়েছে।’ (বুখারি : ১/১৭৩, মুসলিম : ২/৬০৮)।
ঈদের দিনের সুন্নত ও মুস্তাহাব: (১) মেসওয়াক করা সুন্নত। (২) গোসল করা সুন্নত। (৩) সুগন্ধি ব্যবহার করা সুন্নত। (৪) কিছু খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নত। বিজোড় সংখ্যায় যেকোনো মিষ্টিদ্রব্য খাওয়া উত্তম; খেজুর অতি উত্তম। (৫) ঈদগাহে হেঁটে যাওয়া উত্তম। এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া অন্য রাস্তা দিয়ে আসা মুস্তাহাব। (৬) ঈদগাহে যাওয়ার পথে নিচু স্বরে তাকবির (আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ) পড়া সুন্নত। (৭) সাধ্যমতো উত্তম পোশাক পরিধান করা মুস্তাহাব। (৮) নামাজের জন্য ঈদগাহে যাওয়ার আগে সদকায়ে ফিতর আদায় করা সুন্নত। (দাতা ও গ্রহীতার সুবিধার্থে রমজানেও প্রদান করা যায়)। (৯) ঈদের দিন চেহারায় খুশির ভাব প্রকাশ করা ও কারো সঙ্গে দেখা হলে হাসিমুখে কথা বলা মুস্তাহাব। (১০) আনন্দ-অভিবাদন বিনিময় করা মুস্তাহাব। (ফাতাওয়া শামি : ১/৫৫৬, ৫৫৭, ৫৫৮; হেদায়া : ২/৭১; বোখারি : ১/১৩০, ইবনে মাজাহ : ৯২)।
ঈদের নামাজ দুই রাকাত আর তা ওয়াজিব। এতে আজান ও ইকামত নেই। যাদের ওপর জুমার নামাজ ওয়াজিব, তাদের ওপর ঈদের নামাজও ওয়াজিব। ঈদের নামাজ ময়দানে পড়া উত্তম। তবে মক্কাবাসীর জন্য মসজিদে হারামে উত্তম। শহরের মসজিদগুলোতেও ঈদের নামাজ জায়েজ আছে। (বুখারি : ১/১৩১; ফাতাওয়া শামি : ১/৫৫৫, ১/৫৫৭; আল মুহাজ্জাব : ১/৩৮৮)। সূর্য উদিত হয়ে এক বর্শা (অর্ধ হাত) পরিমাণ উঁচু হওয়ার পর থেকে শুরু হয়ে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত বাকি থাকে। তবে ঈদুল ফিতরের নামাজ একটু দেরিতে পড়া সুন্নত; যেন নামাজের আগেই বেশি থেকে বেশি সদকাতুল ফিতর আদায় হয়ে যায়। (ফাতহুল কাদির : ২/৭৩, আল মুগনি : ২/১১৭)।
নামাজের নিয়ত: মুখে উচ্চারণ করার কোনো প্রয়োজন নেই। মনে মনে নির্দিষ্ট করতে হবে যে আমি এ ঈদের নামাজ কিবলামুখী হয়ে এই ইমাম সাহেবের পেছনে অতিরিক্ত ছয় তাকবিরের সঙ্গে আদায় করছি। ঈদের নামাজে অতিরিক্ত ছয়টি তাকবির ওয়াজিব। প্রথম রাকায়াতে তাকবিরে তাহরিমা ও ‘ছানা’র পর তিন তাকবির। দ্বিতীয় রাকাতে কেরাতের পর রুকুতে যাওয়ার আগে তিন তাকবির। এ তাকবিরগুলো বলার সময় ইমাম-মুকতাদি সবাইকে হাত উঠাতে হবে। তৃতীয় তাকবির ছাড়া প্রতি তাকবিরের পর হাত ছেড়ে দিতে হবে। কেউ যদি এ তাকবিরগুলো না পায়, তাহলে সে রুকুতে থাকা অবস্থায় আদায় করে নেবে। কারো পূর্ণ এক রাকাত ছুটে গেলে সে দ্বিতীয় রাকাতে কেরাতের পর তাকবিরগুলো আদায় করে নেবে। কেরাতের আগে আদায় করারও সুযোগ রয়েছে। নামাজ শেষে খুতবা প্রদান ইমামের জন্য সুন্নত; তা শ্রবণ করা নামাজির জন্য ওয়াজিব। (ফাতাওয়া শামি : ১/৫৫৯, ৫৬০)। কারো ঈদের নামাজ ছুটে গেলে শহরের অন্য কোনো জামায়াতে শরিক হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। পরিশেষে যদি নামাজ ছুটেই যায় তাহলে এর কোনো কাজা নেই। তবে চার রাকাত এশরাকের নফল নামাজ আদায় করে নেবে এবং তাতে ঈদের নামাজের মতো অতিরিক্ত তাকবির বলবে না।
বাংলাদেশে বসবাসরত বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে ঈদুল ফিতর একটি আনন্দঘন ধর্মীয় অনুষ্ঠান। তবে কালক্রম এটি সামাজিক উৎসবের চরিত্র গ্রহণ করেছে। যে যেখানেই অবস্থান করুক না কেন ঈদের দিন সকলেই পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে আগ্রহী হয়। বিশেষ প্রতিবন্ধকতা ছাড়া সকলেই নাড়ির টানে নিজের শেকড়ের কাছে ফিরতে চায়। সকল আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা হওয়ার এ যেন এক মোক্ষম সুযোগ। যদিও ঈদ ধর্মীয় অনুষ্ঠান; তারপরও প্রথমত বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি আর দ্বিতীয়ত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কারণে এই উৎসবের আনন্দ সকল জনগোষ্ঠীর লোকজন উপভোগ করে।
শুধু সামাজিক সম্প্রীতিই নয়, সম্পদের অসম বন্টনের কারণে যেন কারও ঈদের খুশি বিলীন না হয় তাই ধনীর জন্য নির্ধনকে সাহায্য করার রীতিও প্রচলিত। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-
‘ঈদ-উল-ফিতর আনিয়াছে তাই নব বিধান,/ ওগো সঞ্চয়ী, উদ্বৃত্ব যা করিবে দান,/
ক্ষুধার অন্ন হোক তোমার!/ ভোগের পেয়ালা উপচায়ে পড়ে তব হাতে,/ তৃষ্ণাতুরের হিস্যা আছে ও পেয়ালাতে,/ দিয়া ভোগ কর বীর, দেদার,/ বুক খালি করে আপনারে আজ দাও জাকাত,/ করো না হিসাবী আজি হিসাবের অঙ্কপাত!’।
এই সাম্য ও সমতার বন্ধনে মানুষ নিজেকে যুক্ত করতে চায়, মানুষ তার পরিবারের সকলের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিতে চায়। মুসলমানের সামাজিক জীবনে ঈদের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। ধর্মঘনিষ্ঠ মানসিকতার কারণে তারা ঈদের দিন যেমন ধর্মপালন করে তেমনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে নিজেদের খুশিতে অন্যকেও খুশি করে থাকে। সৌহার্দ্যরে যে বন্ধন মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে ঈদের কারণে তা যেন সারা বছর থাকে। এটি সকলেই চায়। শুধু সামজিক জীবন নয়, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও রাজনৈতিক সহাবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠতে পারে এই ঈদের কল্যাণে।
লেখক : এম এ কবীর, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি।
Leave a Reply